ধর্মমন্ত্রী ফরিদুল হক খানের খোয়া যাওয়া আইফোন মোবাইল হ্যান্ডসেটটি মালয়েশিয়া থেকে উদ্ধার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগ।
গত ৩০ এপ্রিল ধর্মমন্ত্রী ফরিদুল হক খানের আইফোন ১৫ প্রো ম্যাক্স মডেলের মোবাইল হ্যান্ডসেটটি খোয়া যায়।
পরে মন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন জামালপুর জেলার ইসলামপুর থানায় হারানো মূলে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।
ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তথ্য-প্রযুক্তিগত সহায়তায় ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে মোবাইল হ্যান্ডসেটটি উদ্ধার করা হয়৷ তবে এ উদ্ধার অভিযানে বের হয়ে আসতে শুরু করে হ্যান্ডসেট আইফোন চুরি চক্রের হোতাসহ চক্রের সদস্যদের তথ্য৷
চুরি যাওয়া এ মোবাইল হ্যান্ডসেটটি চুরির অভিযোগে আন্তজেলা মোবাইল চোর চক্রের ৯ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগ।
তদন্তে ও গ্রেপ্তার আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে ৮০টি চুরি চক্রের সন্ধান পায় গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। এসব চক্রের নিয়ন্ত্রণকারী হোতা জাকির হোসেন। তার নেতৃত্বেই ঢাকাসহ সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এসব চোরচক্রের সদস্যরা।
কখনও ছোঁ মেরে বা কখনো পকেট মার করে দামি আইফোন হ্যান্ডসেট নিমিষেই নিয়ে যায় চক্রের সদস্যরা। শুধু মাত্র চলতি বছরের গত ৬ মাসে এসব চক্রের সদস্যরা আইফোনসহ দাবি অন্তত ১০ হাজার মোবাইল হ্যান্ডসেট চুরি করেছে বলে জানান ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা (ডিবি) বিভাগ। চুরি বা ছিনতাই করা এসব মোবাইল হ্যানসেটের অধিকাংশ চলে যায় চট্টগ্রামের রিয়াজ উদ্দিন মার্কেটের বিভিন্ন দোকানে। সেখান থেকে একাধিক হাত বদল হয়ে এসব আইফোন চলে যায় বিদেশে।
বুধবার (৫ জুন) দুপুরে গোয়েন্দা (ডিবি) কার্যালয়ে কনফারেন্স রুমে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান ডিএমপি’র অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ।
তিনি বলেন, আমরা প্রায়ই অভিযোগ পাচ্ছি যে, ঢাকা ও আশপাশ এলাকায় দামি মোবাইল হ্যানসেট ও আইফোন ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে চোর চক্রের সদস্যরা। অনেক ভিআইপিরও মোবাইল ছিনতাই হয়। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রায় এমন অভিযোগ আসে। এরকম অনেক অভিযোগ আমরাও পাই।
আমাদের কাছে এমন একটা অভিযোগ আসে ধর্মমন্ত্রী তার নিজ জেলা জামালপুরে সাবেক প্রতিমন্ত্রী রাশেদ মোশাররফের স্ত্রীর জানাজায় গিয়েছিলেন। সেখানে জানাজা থাকা অবস্থায় তার পকেট থেকে তার ব্যবহৃত আইফোনটি খোয়া যায়। এরপর তিনি আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানান। তিনি থানায় একটি জিডি করেন। সেই জিডির প্রেক্ষিতে তদন্তে নামে আমাদের ডিবি-সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগ। বিভাগের ওয়েব বেইজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের টিম ইনচার্জ এডিসি আশরাফউল্লাহর নেতৃত্বে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলার মোবাইল হ্যান্ডসেট চোরদের কাছ থেকে কমমূল্যে মোবাইল হ্যান্ডসেট ক্রয় করে তা অবৈধ পথে ভারত, দুবাই, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে পাচার করে আসছিল গ্রেপ্তার চোরচক্রের ৯ সদস্য। তাদের গ্রেপ্তার অভিযানে তাদের কাছ থেকে ৬৩টি চোরাই মোবাইল হ্যান্ডসেট উদ্ধার করা হয়।
গ্রেপ্তাররা হলেন- চোর চক্রের সর্দার মো. জাকির হোসেন (৪০), সদস্য মাসুম শরীফ (৪১), জিয়াউল মোল্লা জিয়া (৪৮), রাজিব খাঁন মুন্না (২২), আল আমিন মিয়া (২০), আনোয়ার হোসেন সোহেল (২৭), বিল্লাল হোসেন (৩৭), খোকন আলী (৩৬) ও মো. রাসেল(৩৮)।
ধর্মমন্ত্রীর খোয়া যাওয়া সেই দামি মোবাইল হ্যান্ডসেটটি মালয়েশিয়া থেকে উদ্ধার করা হয়। আজকে সেটা মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে হস্তান্তর করা হবে বলে যোগ করেন হারুন অর রশীদ।
তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে হারুন বলেন, পরস্পর যোগসাজশে বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা সমাবেশ, সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন অনুষ্ঠান, হাট-বাজার, মসজিদ (নামাজের সময়), জানাজা নামাজ অথবা লোক-সমাগম হয় এমন স্থানে উপস্থিত হয়ে দামি মোবাইল হ্যান্ডসেট ব্যবহারকারীদের টার্গেট করে। তাদের পকেট থেকে মোবাইল হ্যান্ডসেট চুরি করে। চোরেরা তাদের চোরাইকৃত মোবাইল হ্যান্ডসেটগুলো চক্রের সর্দার জাকির হোসেন (৪০) ও অন্যতম সহযোগী রাসেল, খোকন, বিল্লাল হোসেনসহ অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের কাছে বিক্রি করে।
হারুন অর রশীদ বলেন, সর্দার জাকির হোসেন তার ক্রয়কৃত চোরাই মোবাইল হ্যান্ডসেটগুলো কুরিয়ারযোগে চট্টগ্রামের রিয়াজ উদ্দিন বাজারের মোবাইল ব্যবসায়ী নজরুল ও কামরুজ্জমান হীরুদের কাছে পাঠিয়ে দেয়। পরে তারা অজ্ঞাতনামা আসামিদের সহযোগিতায় আইফোনসহ দামি মোবাইল হ্যান্ডসেটগুলো ভারত, দুবাই, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে দেয়।
অপর গ্রেপ্তার খোকন আলী ও বিল্লাল হোসেন মোবাইল সার্ভিসিংয়ের আড়ালে চোরাই মোবাইল ক্রয় করে। তারা লক খুলে এবং মূল আইএমইআই পরিবর্তন করে অধিক মূল্যে পূনরায় লোকাল মার্কেটে বিক্রি করে দেয়। গ্রেপ্তার জাকির হোসেনসহ সবার নামে রয়েছে একাধিক মামলা।
ডিএমপি’র এ অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, বিভিন্ন উপায়ে ফোনগুলো ভারত, দুবাই, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে দিয়ে বাজারজাত করে। বিদেশে পাঠানোর আগে তারা বিভিন্ন মোবাইল টেকনিশিয়ানদের সহায়তায় ফোন লক খোলার চেষ্টা করে এবং প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে মূল ব্যবহারকীর কাছ থেকে আই ক্লাউডের পাসওয়ার্ড সংগ্রহ করে। যেসব ফোনের পাসওয়ার্ড এবং আই ক্লাউড পাসওয়ার্ড সংগ্রহ করতে পারে সে ফোনগুলো তারা উচ্চ মূল্যে বিক্রি করে এবং বিদেশে পাঠিয়ে দেয়। যে ফোনগুলোর লক এবং আই ক্লাউড পাসওয়ার্ড সংগ্রহ করতে পারে না সেগুলো তুলনামূলক কম দামে বিক্রি করে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়।
বিভিন্ন জেলায় এ রকম ছোট ছোট প্রায় ৮০টি গ্রুপ চুরির কাজ করে, যাদের হ্যান্ডসেটগুলো ক্রয় করে থাকে জাকির, কালু, কামরুজ্জামান হীরু এবং মোবাইল ব্যবসায়ী নজরুল।
ধর্মমন্ত্রীর খোয়া যাওয়া মোবাইল উদ্ধার সম্পর্কে ডিবি পুলিশ জানায়, মন্ত্রীর উপস্থিতি উপলক্ষে যেসব ছবি তোলা হয় সেগুলো বিশ্লেষণ করে পাঞ্জাবি টুপি পরিহিত একটি ছবিতে থাকা যুবককে শনাক্ত করা হয়। তবে সেই ছবির যুবককে এলাকার লোকজন চিনতে পারেনি। ডিবি সাইবারের তদন্ত দল সেই সংগৃহীত ছবি সূত্রধরে ওয়েব বেইজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিম (উত্তর) কাজ শুরু করে। সোর্স এবং তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় চোরকে চিহ্নিত করা হয়। ধর্মমন্ত্রীর মোবাইল হ্যান্ডসেটটি চুরি করেছিলেন মুন্না নামে চক্রের সদস্য। সে প্রতিদিন বিভিন্ন জেলায় চুরি করতে যাওয়ার কারণে তার প্রকৃত অবস্থান নির্ণয়ে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। মন্ত্রীর মোবাইল হ্যান্ডসেট চুরির প্রায় ১ মাস পর মুন্নার প্রকৃত অবস্থান নির্ণয় করে গ্রেপ্তার করা হয়।
হারুন বলেন, এক মাসে বেশ কয়েকটি হাত বদল হয়ে চোর চোক্রের অন্যতম পৃষ্টপোষক কামরুজ্জামান হীরু ফোনটি মালয়েশিয়ায় পাঠিয়ে দেয়। বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে প্রকৃত ফোনটি মালয়েশিয়া থেকে ফেরত আনা হয় এবং যাচাই বাছাইপূর্বক নিশ্চিত হওয়া যায় যে, উদ্ধারকৃত ফোনটি ধর্মমন্ত্রী চুরি যাওয়া ফোন। সেটি আজকে মন্ত্রীর হাতে হস্তান্তর করা হবে।
সবার উদ্দেশে হারুন অর রশীদ বলেন, অনুমোদিত বিক্রয়কেন্দ্র ছাড়া অন্য কোনো স্থান বা ব্যক্তির কাছ থেকে মোবাইল হ্যান্ডসেট ক্রয় না করা। পুরাতন মোবাইল হ্যান্ডসেট ক্রয় না করা। চিকিৎসা করার টাকা নেই তাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে মোবাইল বিক্রি করতে চাওয়া ব্যক্তির কাছ থেকে হ্যান্ডসেট ক্রয় না করা। মোবাইলের পূর্ণাঙ্গ তথ্য সম্বলিত রশিদ ছাড়া মোবাইল হ্যান্ডসেট ক্রয় না করা। পাঞ্জাবির পকেটে মোবাইল হ্যান্ডসেট না রাখা। মোবাইল হ্যান্ডসেট চুরি হলে মিথ্যা তথ্য দিয়ে হারানোর জিডি না করে চুরির মামলা করা। ফোন লকে স্ট্রং পাসওয়ার্ড ব্যবহার করা।