বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সিনিয়র সহ-সভাপতি ও খুলনা-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) আব্দুস সালাম মুর্শেদীকে জাল কাগজপত্র তৈরি করে গুলশান আবাসিক এলাকার ১ বিঘা ৭ কাঠা আয়তনের সরকারি একটি বাড়ি বরাদ্দ দেওয়া হয়। বাড়ির মূল্য প্রায় ৫০০ কোটি টাকা।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে জালিয়াতির মাধ্যমে বাড়িটি বরাদ্দ দেয়ার তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু দুদক সালাম মুর্শেদীকে বাদ দিয়ে রাজউক ও গণপূর্তের ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে। সংস্থাটি মূল অভিযুক্ত ব্যক্তিকে মামলা থেকে বাঁচিয়ে দেয়। ওইদিন দুদক থেকে গণপূর্ত সচিবকে চিঠি দেওয়া হয়। চিঠিতে সালাম মুর্শেদীর কাছ থেকে বাড়ি উদ্ধারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। কিন্তু মন্ত্রণালয় এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়নি। ফলে সরকারি বাড়িতে অবৈধভাবে বসবাস করছেন সালাম মুর্শেদী।
এ বিষয়ে মঙ্গলবার (১০ সেপ্টেম্বর) গণপূর্ত সচিব মো. নবীরুল ইসলামের মোবাইলফোনে কল করা হলে তিনি ফোনকল রিসিভ করেননি। দুদকের একজন পরিচালক বলেছেন, সালাম মুর্শেদীর বিরুদ্ধে সরকারি বাড়ি দখল ছাড়াও তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে রাজধানীসহ বিভিন্ন জায়গায় বাড়ি, ফ্ল্যাট ক্রয়সহ স্ত্রী ও নিজ সন্তানদের নামে কোটি কোটি টাকার সম্পদের অর্জনের তথ্য দুদকের গোয়েন্দা ইউনিটের হাতে এসেছে। এছাড়া তার স্ত্রীর নামে দেশের বাইরে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ থাকার অভিযোগ রয়েছে। তার দুর্নীতির মামলা তদন্তকালে এসব বিষয় আমলে নেওয়া হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের একজন কর্মকর্তা বলেন, পরস্পর যোগসাজশে করে জাল কাগজপত্র তৈরি করে গণপূর্ত মন্ত্রণালয় পরিত্যক্ত তালিকাভুক্ত গুলশান আবাসিক এলাকার ১ বিঘা ৭ কাঠা আয়তনের সিইএন (ডি)—২৭ নম্বর, সড়ক নম্বর ১০৪ এর ২৯ নম্বর বাড়ি দখলের অভিযোগে গত ৫ ফেব্রুয়ারি একটি মামলা দায়ের করে। মামলায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও গৃহায়ন গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ১১ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে আসামি করা হয়। কিন্তু বাড়ি দখলকারী সালাম মুর্শেদীকে আসামি করা হয়নি। অনুসন্ধানে সালাম মুর্শেদীর বিরুদ্ধে জাল—জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকার তথ্য—প্রমাণ পাওয়ার পরও কমিশনের নির্দেশে থাকে আসামি করা হয়নি। কমিশন তাকে আসামি না করতে অনুসন্ধান কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। অনুসন্ধান কর্মকর্তা উপায়ন্তর না পেয়ে কমিশনের আদেশ মেনে অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিল করেন। আর সেই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে রাজউক ও গণপূর্তের কর্মকর্তা—কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলা করে। এতে মূল অভিযুক্ত ব্যক্তি বেঁচে যান।
তিনি আরও বলেন, সালাম মুর্শেদী দুদককে জানিয়েছিলেন বাড়িটি যে সরকারি সম্পত্তি তা জানতেন না। এ কারণে কমিশন তাকে মামলায় আসামি না করতে নির্দেশ দিয়েছিল। অথচ ২০১৪ সালে গণপূর্ত থেকে বাড়িটি ছেড়ে দেওয়ার জন্য তাকে চিঠি দিয়েছিল। এরপর চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি বাড়ি দখলের ঘটনায় মামলা হয়েছে। মামলার পরও তিনি বাড়িটি অবৈধভাবে দখলে রাখেন। তার তদবিরে মামলার তদন্ত বিলম্বিত হচ্ছে। দুদক আইন অনুযায়ী ১৮০ দিনের মধ্যে মামলার তদন্ত সম্পন্ন করে বিচারিক আদালতে চার্জশিট দাখিলের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এই সময়ের মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন করতে না পারলে আবেদনের প্রেক্ষিতে আরও ৬০ দিন সময় বার্ধিত করা যাবে। এরপর বেশি সময় অতিক্রম করার কোনো সুযোগ নেই। সবশেষ তথ্য অনুযায়ী সালাম মুর্শেদীর মামলার তদন্ত ৭ মাস পেরিয়ে গেলেও তদন্ত শেষ হয়নি। সঠিকভাবে তদন্ত হলে প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসবে এবং সালাম মুর্শেদী ফেঁসে যেতে পারেন।
মামলার আসামি করা হয় যাদের— রাজউকের সহকারী পরিচালক শাহ মো. সদরুল আলম, রাজউকের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক মো. হাবিব উল্লাহ, সাবেক উপপরিচালক (এস্টেট) আজহারুল ইসলাম, সাবেক পরিচালক (এস্টেট) আব্দুর রহমান ভূঞা, সাবেক সদস্য (এস্টেট) অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম নুরুল হক, সাবেক চেয়ারম্যান হুমায়ূন খাদেম, সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী এম আজিজুল হক, সচিবালয়ের সাবেক সহকারী সচিব আব্দুস সোবহান, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সাবেক শাখা সহকারী মো. মাহবুবুল হক, মীর মোহাম্মদ হাসান ও মীর মো. নুরুল আফসার।
বাড়ি উদ্ধারে দুদকের চিঠি : সালাম মুর্শেদীর দখলে থাকা বাড়ি উদ্ধারের জন্য চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি গণপূর্ত সচিবকে চিঠি দেয় দুদক। সংস্থাটির সচিব মো. মাহবুব হোসেন স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, আব্দুস সালাম মুর্শেদী ও রাজউক চেয়ারম্যানসহ অন্যান্যদের সহায়তায় গুলশানের পরিত্যক্ত বাড়িটি দখল করা হয়েছে। দুদকের অনুসন্ধানে প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত জমির মালিকানা কাগজপত্র জাল—জালিয়াতির মাধ্যমে সৃজন করা হয়েছে। বিষয়টি পরীক্ষা—নিরীক্ষা করে বাড়িটি উদ্ধারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করা হলো। কিন্তু ওই চিঠির পরও বাড়িটি উদ্ধার করা হয়নি। এর আগে ২০২২ সালের ১১ আগস্ট বাড়ি দখলের বিষয়টি তদন্ত করে প্রতিবেদন পাঠানোর জন্য চিঠি দেয় দুদক। দুদকের চিঠির প্রেক্ষিতে গণপূর্ত মন্ত্রণালয় তদন্ত করে ২০২২ সালের ৫ ডিসেম্বর দুদকে একটি প্রতিবেদন পাঠান। ওই প্রতিবেদনটি আমলে নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক।
দুদক অনুসন্ধান প্রতিবেদনে যা আছে : প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৬০ সালের ১ সেপ্টেম্বও গুলশান—২ এর সিইএন (ডি)—২৭ নম্বর, সড়ক নম্বর ১০৪ এর ২৯ নম্বর প্লটটি ঢাকা রি—রোলিং মিলসকে বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্লটটির মালিক আব্দুল হামিদ হাসানালি গং পাকিস্তানি হওয়ায় যুদ্ধের সময় তারা পাকিস্তান চলে যান। ওই সময়ে মো. ওয়াসিউর রহমান নামে এক ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানটির এটর্নি হিসেবে নিজেকে দাবি করে প্লটটিতে বসবাস শুরু করেন। এরপর তিনি ১৯৭২ সালের ২৫ জুন প্লটটি তার স্ত্রী মালেকা রহমানের নামে ক্রয় করা হয়েছে উল্লেখ করেন। যুদ্ধের পর প্লটটি সরকারি পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকাভুক্ত করা হয়। ১৯৭৫ সালে ২৮ অক্টোবর মালেকা রহমান রাজউক ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সহায়তা জাল—জালিয়াতির মাধ্যম ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে প্লটটি পরিত্যক্ত সম্পত্তি অবমুক্ত করেন। এরপর ১৯৯৫ সালে মালেকা রহমানের আবেদনের প্রেক্ষিতে তার সন্তান মীর মোহাম্মদ হাসান ও মীর মোহাম্মদ নুরুল আফছার দান সূত্রে এ প্লটের যৌথ লিজ গ্রহীতা হন। তাদের আবেদনে ১৯৯৭ সালের ৩১ মার্চ প্লটটি সালাম মুর্শেদীর কাছে হস্তান্তরিত হয়। ওই বছরের ২৮ ডিসেম্বর প্লটটি হাসান ও নুরুলের পরিবর্তে হস্তান্তর সূত্রে সালাম মুর্শেদীর নামে নামজারি হয়। প্লটটিতে ২০০৪ সালে মুর্শেদীকে ইমারত নির্মাণের জন্য নক্সা অনুমোদনের ছাড়পত্র দেয় রাজউক। এরপর থেকে বাড়িটি তার দখলে আছে।
সূত্রে আরও জানা গেছে, ১৯৯৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ইস্যু করা নথির জন্য গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার চিঠি পাঠায় দুদক। ওই চিঠির প্রেক্ষিতে গত বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর গণপূর্ত মন্ত্রণালয় দুদকে চিঠি পাঠানো হয়। গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব মোহাম্মদ খাদেমুর রহমান স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখার এন্ট্রি রেজিস্টার যাচাই করে নথিটি পাওয়া যায়নি। রেজিস্টার পাওয়া গেলেও ওই স্মারকযুক্ত কোনো চিঠি নেই। অর্থাৎ চিঠি ছিল ভুয়া।
আর সেই চিঠির ভিত্তিতে বাড়িটি সালাম মুর্শেদীকে বরাদ্দ দেয় রাজউক। রাজউকের একটি সিন্ডিকেট পরিত্যক্ত সম্পত্তি বরাদ্দের পেছনে কাজ করেছে। আর এর নেপথ্যে ছিলেন সাবেক এমপি সালাম মুর্শেদী। সালাম মুর্শেদীর অবৈধভাবে বাড়ি দখল নিয়ে ২০২৩ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি উচ্চ আদালতে রিট করেন ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন।