এস আলমের নামে-বেনামে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকার ঋণ নিয়ে বিপাকে পড়েছে দেশের সাতটি ইসলামী ব্যাংক। পতিত সরকারের প্রধান অর্থ জোগানদাতা আলোচিত এ ব্যবসায়ী গ্রুপের মালিকানায় ছিল এ ব্যাংকগুলো। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ওইসময় এসব ঋণের কোনো কিস্তি পরিশোধ করা হতো না। পিএস আকিজ উদ্দিন, মিফতা উদ্দিন, জে কিউ এম হাবিবুল্লাহ, ইউনিয়ন ব্যাংকের এমডি মোকাম্মেল, কমার্স ব্যাংকের ডিএমডি কাদেরের নেতৃত্বে একাধিক টিম এসব ঋণ নিয়মিত তদারকি করত। নতুন ঋণ সৃষ্টি করে পুরনো ঋণ পরিশোধ করা হতো। আবার পরিশোধ না করেই নানা ফন্দিফিকিরের মাধ্যমে এসব ঋণ নিয়মিত দেখানো হতো। কিন্তু ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা আন্দোলনের মুখে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর এস আলম ও তার সহযোগীরাও পালিয়ে গেছেন। এখন এসব ঋণ আপনা-আপনিই খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, আগামী তিন মাসের মধ্যেই এসব ঋণের বেশির ভাগ অংশই খেলাপি হয়ে যাবে। আর খেলাপি হলে প্রভিশন সংরক্ষণ বেড়ে যাবে। এতে ডিসেম্বরে ব্যাংকের বার্ষিক হিসেব কিভাবে সমাপ্তি টানবেন তা নিয়ে এখন থেকেই তারা দুশ্চিন্তায় ভুগছেন।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, অফশোর ব্যাংকিং মিলে শুধু ইসলামী ব্যাংক থেকেই এস আলম বের করে নিয়েছে প্রায় এক লাখ তিন হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৮ হাজার কোটি টাকাই অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছে। ইসলামী ব্যাংকের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এস আলমের প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে নগদ এলসির মাধ্যমে পণ্য আনা হয়েছে। পণ্যও বিক্রি করা হয়েছে। কিন্তু এস আলম ব্যাংকের টাকা ফেরত না দিয়ে বিদেশে পাচার করেছে। বাধ্য হয়ে ইসলামী ব্যাংক বাজার থেকে ডলার কিনে এলসির দায় পরিশোধ করেছে। আর এ জন্য এস আলমের নামে বাধ্যতামূলক ঋণ সৃষ্টি করা হয়েছে। এসব ঋণের অর্থ সর্বোচ্চ এক বছরের মধ্যে ফেরত দেয়ার কথা। কিন্তু এক বছরের মধ্যেও ফেরত দেয়া হয়নি। বিশেষ বিবেচনায় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আরো এক বছরের সময় দেয়া হয়েছে। দুই বছরও পার হয়ে গেছে। এর পরেও এসব অর্থ ফেরত দেয়া হয়নি। বাধ্য হয়ে ব্যাংকটি এখন এস আলমের নামে এসব ঋণ ফোর্সঋণ সৃষ্টি করা হয়েছে। এসব ঋণ আর পরিশোধ করা হচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট এক সূত্র জানিয়েছে, ইসলামী ব্যাংকে এস আলমের পিএস আকিজ উদ্দিন, মিফতা উদ্দিন ও কোম্পানি সেক্রেটারি জে কিউ এম হাবিবুল্লাহর নেতৃত্বে একাধিক টিম ছিল। তাদের কাজই ছিল কিভাবে এস আলমের নামে ভুয়া প্রতিষ্ঠান খুলে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর বিপরীতে ভুয়া ঋণ সৃষ্টি করে বের করে নেয়া যায়। তাদের ক্ষমতার দাপট এমনই ছিল যে, ইসলামী ব্যাংকের প্রকৃত মেধাবী কর্মকর্তা তাদের এ অপকর্মের বিরুদ্ধে কোনো কথাই বলতে পারতেন না। যারাই প্রতিবাদ করেছে তাদেরকেই বদলি, হয়রানি ও চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। ব্যাংটিতে এস আলমের এসব লাঠিয়াল বাহিনীর সদস্যদের কোনো ধরনের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই রাতারাতি বড় বড় পদে পদোন্নতি দেয়া হতো। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা বের করে পাচারের পদ দেখানো হাবিবুর রহমানকে কয়েক ধাপ পদোন্নতি দেয়া হয়। পরে স্যোশাল ইসলামী ব্যাংকে ডিএমডি করে পদায়ন করা হয়। অথচ হাবিবুর রহমানের সাথে যারা ইসলামী ব্যাংকে এক সাথে চাকরিতে নিয়োগ পেয়েছিলেন তাদের বেশির ভাগ সিনিয়র অফিসার, কেউ ফাস্ট এভিপি। তেমনিভাবে ইউনিয়ন ব্যাংকের এমডি মোকাম্মেল, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ডিএমডি আবদুল কাদেরসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার প্রধান কাজই ছিল নানাভাবে এস আলমের ভুয়া প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করে তার বিপরীতে টাকা বের করে পাচার করে দেয়া।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, এসব ঋণ এতদিন বিভিন্নভাবে নিয়মিত দেখানো হতো। নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিত না। ফলে বছরের পর বছর ব্যাংকগুলোর আর্থিক ভিত দুর্বল হতে থাকে। গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করার পরার এসব আলম ও তার দোসরাও গা ঢাকা দিয়েছে। বেশির ভাগই দেশ থেকে পালিয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর ইতোমধ্যে ব্যাংকগুলো পর্ষদ ভেঙে দিয়ে পুনর্গঠন করেছেন। ফলে এখন ব্যাংকগুলোতে এস আলমের লুটপাটের প্রকৃত চিত্র বের হয়ে আসছে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, আগামী তিন মাসে এস আলম, তার পিএস আকিজ উদ্দিনের লুটপাটের মাধ্যমে বের করে নেয়া অর্থ খেলাপি হয়ে যাবে। এতে ইউনিয়ন, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের প্রায় ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ অর্থ খেলাপি হয়ে যাবে। অন্য ব্যাংকগুলোরও প্রায় অর্ধেক ঋণখেলাপি হয়ে যাবে। আর খেলাপি হলে তার বিপরীতে নীতিমালা অনুযায়ী প্রভিশন রাখতে হবে। মুনাফা দিয়ে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। কিন্তু যেখানে মুনাফাই কমে যাবে, সেখানে কিভাবে প্রভিশন রাখলে তা নিয়ে ব্যাংকাররা এখন থেকেই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। তারা জানিয়েছেন, ব্যাংকগুলোর সম্ভাব্য এ বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। তা না হলে আর্থিক খাতে বড় ধরনের বিপর্যয় এড়ানো মোটেও সম্ভব হবে না বলে তারা আশঙ্কা করছেন।