গভীর সাগরে বাংলাদেশের পানিসীমায় রীতিমতো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ভারতের জেলেরা। মৌসুমের শেষ দিকে এসে রূপালি ইলিশের বিচরণের বড় ক্ষেত্রগুলো দখলে নিয়েছে তারা। এমনটাই জানিয়েছেন চলমান ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞার কারণে গভীর সাগর থেকে ফিরে আসা একাধিক জেলে।
সোমবার (১৪ অক্টোবর) সকালে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র বরগুনার পাথরঘাটা মৎস্য ঘাটে ফিরে স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে এ অভিযোগ জানিয়েছেন তারা।
মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ঘাটে নোঙর করা রয়েছে কয়েক শতাধিক ট্রলার। বরগুনাসহ উপকূলীয় বাগেরহাট, পিরোজপুর, ভোলা, পটুয়াখালী, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসা পরিচালনা করেন পাথরঘাটার বিএফডিসি ঘাটে। অবরোধ শেষে এখান থেকেই তাদের ট্রলারগুলো সাগরে মাছ শিকারে পাঠাবেন ট্রলার মালিক ও আড়ৎদাররা।
জানা গেছে, গত ১২ অক্টোবর দিবাগত রাত ১২টা থেকে এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়। যা আগামী ৩ নভেম্বর পর্যন্ত সাগর ও নদীগুলোতে জারি থাকবে। এ সময়ে সাগর ও নদীতে ইলিশসহ সব ধরনের মাছ শিকার, মজুত ও পরিবহণ দণ্ডনীয় অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হবে। আইন অনুযায়ী, নিষেধাজ্ঞা থাকাকালীন ইলিশ মাছ আহরণ ও বিক্রি করলে দায়ী ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ দু’বছরের সশ্রম কারাদণ্ড বা পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানাসহ উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।
সমুদ্র থেকে ফিরে আসা জেলেদের অভিযোগ, প্রতি বছরই ৬৫ দিন এবং ২২ দিনে নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশী জেলেরা সাগর থেকে সরকারি নির্দেশনা পেয়ে ফিরে আসে। এ সুযোগে ভারতের জেলেরা বাংলাদেশী পানিসীমার মধ্যে প্রায় ৮০ থেকে এক শ’ কিলোমিটার পর্যন্ত ঢুকে মাছ শিকার করে নিয়ে যায়। ভারতের জেলেদের প্রতিবাদও করা যায় না। প্রতিবাদ করলেই হ্যান্ড মাইক দিয়ে সরে যেতে বলে। তাদের কথা না শুনলে বাংলাদেশী জেলেদের উপর ইট-পাথর নিক্ষেপ করে। ট্রলার এবং প্রযুক্তি শক্তিশালী হওয়ায় মুহূর্তের মধ্যেই তাদের পার্শ্ববর্তী জেলেদের সাথে নিয়ে হামলা করেন।
সাগর থেকে ফিরে আসা একাধিক জেলে জানান, ভারতীয় জেলেদের ট্রলারে অনেক শক্তিশালী ইঞ্জিন। তারা বাংলাদেশের পানিসীমায় মধ্যে ফেয়ারওয়ে বয়া, ডিমের চর, সোনার চর, চালনার বয়া, কবরখালী, মাইজদীর বয়াসহ সাগরে ইলিশ বিচরণের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় এসে জাল ফেলে মাছ শিকার করে নিয়ে যায়। ভারতের ট্রলারগুলোর জেলেদের কিছু বললেই ওয়ারলেস এর মধ্যমে তাদের আশেপাশে থাকা ভারতের একাধিক ট্রলার নিয়ে এসে হামলা করে। আমাদের জালের মাছ ধরে নিয়ে জাল কেটে দিয়ে যায়। আমাদের ট্রলার তাদের ট্রলারের সাথে বেঁধে ভারতের পানিসীমায় নিয়ে ভারতের পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেয়ার ভয় দেখায়। এতে জেলেদের লাখ লাখ টাকার ক্ষতি হয়। আমাদের সাগরে আমরা মাছ শিকারে গিয়ে ভারতের জেলেদের জন্য অসহায় অবস্থায় থাকতে হয়। এ ঘটনা একাধিকবার ট্রলার মালিক সমিতির কাছে অভিযোগ দেয়ার পরেও কোনো কাজ হয়নি। এগুলো ভারতীয় জেলের একটা নিয়ম হয়ে গেছে।
তারা আরো জানান, দুর্গাপূজার জন্য ভারতে বাংলাদেশী ইলিশের অনেক চাহিদা। কিছুদিন আগে বাংলাদেশ সীমানার দক্ষিণ পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের সুন্দরবন ও কুয়াকাটার কাছাকাছি এসে ইলিশ শিকার করেছে ভারতীয় জেলেরা। একদিকে দুর্গাপূজা অন্যদিকে বাংলাদেশে ২২ দিনের ইলিশ শিকারে নিষেধাজ্ঞার এ সুযোগটিই ভারতের জেলেরা নিয়েছে। এর একটা সমাধান হওয়া উচিৎ বলে দাবি করেন জেলেরা।
এ বিষয়ে বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের পানিসীমার মধ্যে ভারতীয় জেলেদের অনুপ্রবেশের বিষয়টি নতুন নয়। ৬৫ দিনে এবং ২২ দিনের মাছ শিকারের ওপর নিষেধাজ্ঞার এ সময়টিতে বাংলাদেশ সমুদ্রে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ভারতের সাগরে নিষেধাজ্ঞা থাকে না। ও সময় বাংলাদেশের জেলেরা সরকারি আইন মেনে সমুদ্রে মাছ শিকার থেকে বিরত থাকে। ভারতীয় জেলেরা এ সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের পানিসীমার এর মধ্যে ঢুকে মাছ শিকার করে নিয়ে যায়। প্রতি বছরই ইলিশের মৌসুমে এ কাজটি করে ভারতীয় জেলেরা। আমাদের জেলেরা প্রায়ই অভিযোগ করেন ভারতীয় জেলেরা তাদের ওপর হামলা করে মাছ-জাল ছিনিয়ে নিয়ে জেলেদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে চলে যায়। বাংলাদেশের যে জায়গাগুলোতে বেশি পরিমাণ ইলিশ পাওয়া যায় সেই জায়গাগুলো ভারতীয় জেলেরা দখল করে নেয়। বর্তমান সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রতি অনুরোধ থাকবে তিনি যেন জেলেদের এই দুর্দশার সময়ে সমুদ্রে নৌ-বাহিনী এবং কোস্টগার্ডের তৎপরতা জোরদার করেন।
কোষ্টগার্ড দক্ষিণ জোনের কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মো: হারুন-অর-রশিদ মুঠোফোনে সাংবাদিকদের জানান, বাংলাদেশের পানিসীমায় ভারতীয় জেলেদের অনুপ্রবেশ ঘটনা ঘটে। তবে সামনের দিনগুলোতে টহল জোরদার বাড়িয়ে ভারতীয় জেলেদের অনুপ্রবেশ বন্ধ করব। এরকম অভিযোগ আমরা আর নিতে চাই না। এজন্য গভীর সমুদ্রে জাহাজের পাশাপাশি স্পেশাল টহলের জন্য ইতিমধ্যে অতিরিক্ত শক্তিশালী ট্রলার ও স্পিড বোট প্রস্তুত করা হয়েছে এবং অভিযান অব্যাহত রয়েছে।