গভীর সংকটে দেশের তৈরি পোশাক, টেক্সটাইল ও নিট পোশাক খাত। শিল্প মালিকরা বলছেন, জ্বালানির সংকট, শ্রমিক অসন্তোষ ও ব্যাংক খাতের অস্থিতিশীলতা এই খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এতে গত এক বছরে তৈরি পোশাক, নিটওয়্যার ও টেক্সটাইলশিল্পের ১৪০টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্যে তৈরি পোশাক খাতে ৭৬টি, নিট খাতে ৫০টি এবং টেক্সটাইল খাতের ১৪টি কারখানা রয়েছে।
এক বছরে ১৪০টি কারখানার মোট ৯৪ হাজার কর্মী চাকরি হারিয়েছেন বলে খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন। সম্প্রতি বেক্সিমকো গ্রুপ তাদের ১৫টি পোশাক কারখানার প্রায় ৪০ হাজার কর্মী ছাঁটাই করেছে। সব মিলিয়ে বন্ধ ১৫৫ কারখায় এক লাখ ৩৪ হাজার কর্মী চাকরি হারিয়েছেন।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ, ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদহার, কাঁচামাল আমদানিতে এলসি সমস্যা, শিল্পে অব্যাহত গ্যাসসংকট, গ্যাস ট্যারিফ বৃদ্ধি করা, বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ না পাওয়া, অব্যাহতভাবে শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন খরচ বাড়ায় অনেকে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছেন না। আবার অনেকে কারখানায় শ্রমিকদের বেতন দিতে না পেরে কারখানা বন্ধ করে দিয়েছেন।
দেশের রপ্তানি আয়ের সিংহ ভাগ অবদান রাখা শিল্পে অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশে রপ্তানি বাজারে ভাগ বসাচ্ছে প্রতিবেশী দেশগুলো। এতে কারখানার মালিক যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমনি দীর্ঘ মেয়াদে দেশের রপ্তানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ভাটা পড়েছে।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশটিতে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি কমেছে ৩.৩৩ শতাংশ। এর বিপরীতে ভারত, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া থেকে পোশাক আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। গত এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত আগের বছরের তুলনায় ভারতের পোশাক রপ্তানি ৩৫ শতাংশ বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্রয়প্রবণতার এই পরিবর্তনকে ব্যবসায়ীরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে দেখছেন। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই প্রবণতা মোকাবেলায় বাংলাদেশের পোশাক খাতকে নতুন কৌশল নিতে হবে।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) জানিয়েছে, এক বছরে সংগঠনটির সদস্যভুক্ত ৭৬টি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এসব কারখানায় কাজ করা ৫১ হাজার কর্মী চাকরি হারিয়েছেন। শ্রমিকদের ঠিকমতো বেতন দিতে পারছে না অন্তত ১৫৮টি কারখানা।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) জানিয়েছে, এক বছরের মধ্যে এই খাতের ৫০টির বেশি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্যে ৩৫ হাজারের বেশি শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন।
অন্যদিকে বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) সূত্র জানায়, বিটিএমএর ১৪টি বৃহৎ কারখানা পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। এসব কারখানায় কাজ করা প্রায় আট হাজার কর্মী চাকরি হারিয়েছেন।
বিটিএমএ বলেছে, বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে টাকার মূল্যমান কমায় বস্ত্র খাতসহ উৎপাদনমুখী শিল্প-কারখানা কাঁচামাল আমদানি করতে গিয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এতে চলতি মূলধনের ঘাটতিতে পড়েছেন তাঁরা।
দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত পোশাকশিল্পের অস্থিরতার মধ্যেই নতুন করে বেক্সিমকো শিল্পগোষ্ঠী তাদের ১৫টি পোশাক কারখানার প্রায় ৪০ হাজার কর্মী ছাঁটাই করেছে। এ জন্য গাজীপুরে রপ্তানিমুখী পোশাক ও বস্ত্র কারখানাগুলো কার্যাদেশ পায়নি- এমন কারণ দেখিয়েছে।
যদিও শ্রমিকদের দাবি, অর্ডার এলেও মালিকপক্ষ নিজেরাই তা ফেরত দিয়ে কারখানা বন্ধ করে দিয়েছেন। গত ১৫ ডিসেম্বর জারি করা বিজ্ঞপ্তিতে শিল্পগোষ্ঠীটির সব কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিকদের ১৬ ডিসেম্বর থেকে ছাঁটাই কার্যকরের কথা জানানো হয়।
বেক্সিমকোর একটি কারখানার চাকরি হারানো শ্রমিক তানজিনা বেগম (৩৬) বলেন, ‘বন্ধ হওয়ার পাঁচ বছর আগে যোগ দিয়েছিলাম। জীবনে জৌলুস না থাকলেও পরিবারের পাঁচ সদস্যের তিন বেলা খাবার জুটত বেতনের টাকায়। কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন সেই পথ বন্ধ। রংপুরে গ্রামের বাড়িতে বৃদ্ধ মা-বাবা ও স্কুলপড়ুয়া মেয়ে আছে। টাকা না পাঠাতে পারলে তারা না খেয়ে থাকবে। তাদের ওষুধ বন্ধ হয়ে যাবে। মেয়ের লেখাপড়া শেষ হয়ে যাবে।’ তিনি বলেন, ‘কারখানার সামনে এসেছি, যদি কারখানা খোলে-এমন খবরের আশায়।’
জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন বলেন, ‘বিপুলসংখ্যক শ্রমিককে ঝুঁকিতে না ফেলে বেক্সিমকো গ্রুপের অংশীজনদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে কারখানা চালু রাখতে সরকারের কাছে আবেদন জানানো হয়েছে।’