পাওনা টাকা আদায়ের নামে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার গৃহবধূর মৃত্যু: ওসি বলছেন ‘আত্মহত্যা’

  • আপডেট: ১২:৫১:০৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ১ জুন ২০২৪
  • 44

রাজিবপুর থানার ওসি আশিকুর রহমান

কুড়িগ্রামের চর রাজিবপুর উপজেলায় পাওনা টাকা আদায়ের নামে দিনের পর দিন সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক গৃহবধূ। এ ঘটনায় স্থানীয় মাতব্বর ও থানা পুলিশের কাছে বিচার চেয়েও না পেয়ে ক্ষোভ আর অভিমানে বিষপান করেন গৃহবধূ ও তার স্বামী। চার দিন চিকিৎসাধীন থেকে গৃহবধূ মারা যান। সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও মানসিক নির্যাতনে পর্যুদস্ত হয়ে মারা যাওয়া ওই গৃহবধূর মৃত্যুকে ‘আত্মহত্যা’ বলে চালিয়ে দিচ্ছেন খোদ রাজিবপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আশিকুর রহমান।

গৃহবধূর মৃত্যুর আগে দেওয়া জবানির অডিও রেকর্ড সূত্র এবং স্বামী ও পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাড়ি মেরামত করার জন্য ধার নেওয়া টাকা পরিশোধ করতে না পারায় ওই গৃহবধূকে দিনের পর দিন ধর্ষণ করে স্থানীয় কসাই জয়নাল। ধর্ষণের ভিডিও করে গৃহবধূকে ব্ল্যাকমেইল শুরু করে। এক পর্যায়ে জয়নাল তার অপর সহযোগী শুক্কুর, আলম ও সোলেমানকে নিয়ে ওই গৃহবধূকে দিনের পর দিন সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করে। স্বামী বাড়িতে না থাকার সুযোগ নিয়ে প্রায় দুই মাস ধরে এই পাশবিক নির্যাতন চলতে থাকে।

এক পর্যায়ে গৃহবধূ তার স্বামীকে সবকিছু জানান। স্থানীয় মাতব্বরদের কাছে বিচার না পেয়ে ওই দম্পতি থানায় যান। কিন্তু তাদের থানার গেট থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। কসাই জয়নালের সহযোগী রবিউল নামে এক পুলিশ কনস্টেবল তাদের ‘কড়া বিচারের’ আশ্বাস দিয়ে ফিরিয়ে দেন। একই দিন সন্ধ্যায় জয়নাল, শুক্কুর এবং কনস্টেবল রবিউল ও থানার ড্রাইভার মাজহারুলসহ স্থানীয় মাতব্বররা মিলে সালিশ বসান। সালিশে উপযুক্ত বিচার না পেয়ে ক্ষোভ ও অভিমানে পরের দিন (২৪ মে) গ্রামবাসীর সামনে প্রকাশ্যে বিষপান করেন ওই দম্পতি। একাধিক হাসপাতাল ঘুরে চার দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর বাড়ি ফিরে গৃহবধূ মারা যান। স্বামী এখনও অসুস্থ।

মূল অভিযুক্ত কসাই জয়নাল

কসাই গংয়ের ধর্ষণের শিকার হয়ে বিচার না পেয়ে বিষপান এবং কোনও ধরনের আইনি ও মানবিক সহায়তা না পেয়ে মারা গেলেও ওই গৃহবধূর মৃত্যুকে নিছক ‘আত্মহত্যা’ বলে চালিয়ে দিতে তৎপর অভিযুক্ত ব্যক্তি ও তাদের সহযোগীরা। তাদের সেই তৎপরতায় সহায়ক খোদ পুলিশও। এমনকি থানার ওসি আশিকুর রহমানও কোনও ধরনের তদন্ত কিংবা ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন ছাড়াই গৃহবধূর মৃত্যুকে ‘আত্মহত্যা’ দাবি করেছেন।

পুলিশ বলছে, গৃহবধূর মৃত্যুর পর তার এক মামা থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা করেন। পরে মরদেহ মর্গে পাঠানো হয়। কিন্তু এখনও প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি।

গুরুতর অভিযোগ ওঠা ঘটনার জেরে মারা যাওয়া একজন নারীর মৃত্যু ‘আত্মহত্যা’ দাবি করে ওসি বলেন, ‘গৃহবধূর আত্মহত্যার ঘটনায় মামলা হয়েছে। তাকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের বিষয়ে আমাদের কাছে কেউ কোনও অভিযোগ দেয়নি।’

ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পাওয়ার আগেই ‘আত্মহত্যা’ বলা প্রশ্নে ওসি বলেন, ‘প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলে জানানো হয়েছে।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, জয়নাল ও শুক্কুরকে সহযোগিতা করেছেন ভুক্তভোগী দম্পতির মামা আমেশ এবং স্থানীয় মেম্বার আনোয়ার। আরও সহযোগিতা করেছেন পুলিশ কনস্টেবল রবিউল ও থানার ড্রাইভার মাজহারুল। অভিযুক্তদের সঙ্গে যোগসাজশে মামা আমেশই ভিলেনের ভূমিকা পালন করে গেছেন। তারা থানা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে ধর্ষণের ঘটনাটি মামলা পর্যন্ত গড়াতে দেয়নি। বিষপানে গৃহবধূর মৃত্যু হওয়ার পর এটিকে ‘আত্মহত্যা’ হিসেবে চালিয়ে দিতে অপমৃত্যু মামলা নথিভুক্ত করেন ওসি। অথচ বিষপানের পর চার দিন ধরে ওই দম্পতি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। সবকিছু ঘটেছে থানা থেকে ৪০০ গজের ভেতরেই!

জানতে চাইলে ওসি আশিকুর রহমান বলেন, ‘হাসপাতালে পুলিশ কেস আসলে তা থানায় অবহিত করা হয়। কিন্তু ওই দম্পতির বিষপানের বিষয়টি থানায় জানানো হয়নি। আর নির্বাচন উপলক্ষে থানায় পর্যাপ্ত ফোর্স ছিল না। ফলে থানার কাছেই ঘটনাটি ঘটলেও তা পুলিশের নজরে আসেনি।’

পুলিশ কন্সটেবল রবিউলের ভূমিকার সাফাই দিয়ে ওসি বলেন, ‘তিনি (রবিউল) বলেছেন তাকে সালিশে ডাকা হয়েছিল। তিনি গিয়ে চলে এসেছেন। এত কিছু তার জানা ছিল না।’ পুলিশ সদস্যদের ভূমিকা নিয়ে ওঠা অভিযোগ তদন্ত করার আশ্বাস দেন ওসি।

Tag :

পাওনা টাকা আদায়ের নামে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার গৃহবধূর মৃত্যু: ওসি বলছেন ‘আত্মহত্যা’

আপডেট: ১২:৫১:০৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ১ জুন ২০২৪

কুড়িগ্রামের চর রাজিবপুর উপজেলায় পাওনা টাকা আদায়ের নামে দিনের পর দিন সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক গৃহবধূ। এ ঘটনায় স্থানীয় মাতব্বর ও থানা পুলিশের কাছে বিচার চেয়েও না পেয়ে ক্ষোভ আর অভিমানে বিষপান করেন গৃহবধূ ও তার স্বামী। চার দিন চিকিৎসাধীন থেকে গৃহবধূ মারা যান। সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও মানসিক নির্যাতনে পর্যুদস্ত হয়ে মারা যাওয়া ওই গৃহবধূর মৃত্যুকে ‘আত্মহত্যা’ বলে চালিয়ে দিচ্ছেন খোদ রাজিবপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আশিকুর রহমান।

গৃহবধূর মৃত্যুর আগে দেওয়া জবানির অডিও রেকর্ড সূত্র এবং স্বামী ও পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাড়ি মেরামত করার জন্য ধার নেওয়া টাকা পরিশোধ করতে না পারায় ওই গৃহবধূকে দিনের পর দিন ধর্ষণ করে স্থানীয় কসাই জয়নাল। ধর্ষণের ভিডিও করে গৃহবধূকে ব্ল্যাকমেইল শুরু করে। এক পর্যায়ে জয়নাল তার অপর সহযোগী শুক্কুর, আলম ও সোলেমানকে নিয়ে ওই গৃহবধূকে দিনের পর দিন সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করে। স্বামী বাড়িতে না থাকার সুযোগ নিয়ে প্রায় দুই মাস ধরে এই পাশবিক নির্যাতন চলতে থাকে।

এক পর্যায়ে গৃহবধূ তার স্বামীকে সবকিছু জানান। স্থানীয় মাতব্বরদের কাছে বিচার না পেয়ে ওই দম্পতি থানায় যান। কিন্তু তাদের থানার গেট থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। কসাই জয়নালের সহযোগী রবিউল নামে এক পুলিশ কনস্টেবল তাদের ‘কড়া বিচারের’ আশ্বাস দিয়ে ফিরিয়ে দেন। একই দিন সন্ধ্যায় জয়নাল, শুক্কুর এবং কনস্টেবল রবিউল ও থানার ড্রাইভার মাজহারুলসহ স্থানীয় মাতব্বররা মিলে সালিশ বসান। সালিশে উপযুক্ত বিচার না পেয়ে ক্ষোভ ও অভিমানে পরের দিন (২৪ মে) গ্রামবাসীর সামনে প্রকাশ্যে বিষপান করেন ওই দম্পতি। একাধিক হাসপাতাল ঘুরে চার দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর বাড়ি ফিরে গৃহবধূ মারা যান। স্বামী এখনও অসুস্থ।

মূল অভিযুক্ত কসাই জয়নাল

কসাই গংয়ের ধর্ষণের শিকার হয়ে বিচার না পেয়ে বিষপান এবং কোনও ধরনের আইনি ও মানবিক সহায়তা না পেয়ে মারা গেলেও ওই গৃহবধূর মৃত্যুকে নিছক ‘আত্মহত্যা’ বলে চালিয়ে দিতে তৎপর অভিযুক্ত ব্যক্তি ও তাদের সহযোগীরা। তাদের সেই তৎপরতায় সহায়ক খোদ পুলিশও। এমনকি থানার ওসি আশিকুর রহমানও কোনও ধরনের তদন্ত কিংবা ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন ছাড়াই গৃহবধূর মৃত্যুকে ‘আত্মহত্যা’ দাবি করেছেন।

পুলিশ বলছে, গৃহবধূর মৃত্যুর পর তার এক মামা থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা করেন। পরে মরদেহ মর্গে পাঠানো হয়। কিন্তু এখনও প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি।

গুরুতর অভিযোগ ওঠা ঘটনার জেরে মারা যাওয়া একজন নারীর মৃত্যু ‘আত্মহত্যা’ দাবি করে ওসি বলেন, ‘গৃহবধূর আত্মহত্যার ঘটনায় মামলা হয়েছে। তাকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের বিষয়ে আমাদের কাছে কেউ কোনও অভিযোগ দেয়নি।’

ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পাওয়ার আগেই ‘আত্মহত্যা’ বলা প্রশ্নে ওসি বলেন, ‘প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলে জানানো হয়েছে।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, জয়নাল ও শুক্কুরকে সহযোগিতা করেছেন ভুক্তভোগী দম্পতির মামা আমেশ এবং স্থানীয় মেম্বার আনোয়ার। আরও সহযোগিতা করেছেন পুলিশ কনস্টেবল রবিউল ও থানার ড্রাইভার মাজহারুল। অভিযুক্তদের সঙ্গে যোগসাজশে মামা আমেশই ভিলেনের ভূমিকা পালন করে গেছেন। তারা থানা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে ধর্ষণের ঘটনাটি মামলা পর্যন্ত গড়াতে দেয়নি। বিষপানে গৃহবধূর মৃত্যু হওয়ার পর এটিকে ‘আত্মহত্যা’ হিসেবে চালিয়ে দিতে অপমৃত্যু মামলা নথিভুক্ত করেন ওসি। অথচ বিষপানের পর চার দিন ধরে ওই দম্পতি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। সবকিছু ঘটেছে থানা থেকে ৪০০ গজের ভেতরেই!

জানতে চাইলে ওসি আশিকুর রহমান বলেন, ‘হাসপাতালে পুলিশ কেস আসলে তা থানায় অবহিত করা হয়। কিন্তু ওই দম্পতির বিষপানের বিষয়টি থানায় জানানো হয়নি। আর নির্বাচন উপলক্ষে থানায় পর্যাপ্ত ফোর্স ছিল না। ফলে থানার কাছেই ঘটনাটি ঘটলেও তা পুলিশের নজরে আসেনি।’

পুলিশ কন্সটেবল রবিউলের ভূমিকার সাফাই দিয়ে ওসি বলেন, ‘তিনি (রবিউল) বলেছেন তাকে সালিশে ডাকা হয়েছিল। তিনি গিয়ে চলে এসেছেন। এত কিছু তার জানা ছিল না।’ পুলিশ সদস্যদের ভূমিকা নিয়ে ওঠা অভিযোগ তদন্ত করার আশ্বাস দেন ওসি।